Wednesday, February 19, 2020

অরণ্য ডাকছে


জঙ্গলের সাথে আমার পরিচয় জিম করবেটের হাত ধরে। যখন ছোটবেলায় রুদ্রপ্ৰয়াগে গিয়ে সেই আমি গাছটা দেখলাম যার মাথায় মাচা বেঁধে জিম করবেট রুদ্রপ্ৰয়াগের মানুষখেকো বাঘকে মেরে ছিলেন, মনে হয়েছিল আমিও যেন সেই ঘটনার সাক্ষী হলাম। সেই অদম্য আকর্ষণ ভালোবাসায় রূপান্তরিত হলো বুদ্ধ বাবুর লেখনী ধরে বাংরিপোসীর দু রাত্তিরে লবঙ্গীর জঙ্গলে । শৈশবের সরল ভালোবাসা রোমান্টিকতার ছোঁয়ায় এক মহিরুহের আকার নিল। জীবনের রাস্তা হয়েছে সুদূর, ঘুরেছি অনেক আর জঙ্গলের প্রতি আহ্বান হয়েছে দুর্নিবার। তারই টানে এবার আমরা এসেছি 'মোহান' এ । জায়গাটি ভারতের উত্তরখণ্ডের আলমোড়া জেলার অন্তর্গত, রামনগর থেকে ৩০ কিমি মতো আর দিখালা যাবার ধান গির গেট থেকে ৪ কিমি দূরত্বে। বেশি পপুলার না বলে লোকজন এর ভিড় কম।আমরা ছিলাম KMVN এর রেস্ট হাউসে। ৪ বেডের রুম ও নাস্তা ও রাতের খাবার সমেত ছিল আমাদের বুকিং।

ঘরের জানলার পর্দা সরালে সামনেই বিশাল জঙ্গল , মনে হয় হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবো যেকোনো বন্য প্রাণীকে। পাখিদের অকারণ ডাকাডাকি, ঝিঁঝিঁ পোকার কীর্তন জঙ্গলে অর্কেস্ট্রার উপলব্ধি করায়। আমাদের কটেজের চারপাশে শুধু সেগুনের ভিড় আর রাস্তা পার হলেই আরো না জানি কত গাছ এসে ভিড় জমিয়েছে শাল, সেগুন, ইউক্যালিপটাস, অমলতাস। কী তাদের পাতার রঙের বাহার আর অমলতাসের হলুদ ফুল যেন এক ওপেন ক্যানভাস। যে যা চাইছে এক মুঠো রঙ দিয়ে যাচ্ছে। বর্ষা আসন্ন, তাই গ্রীষ্মের দাবদাহে কিছুটা কাহিল হয়ে পড়েছে প্রকৃতি। কিন্তু বাতাস  নিয়ে এসেছে বৃষ্টির খবর, তাই "তার লাগি উন্মনা মন"। সামনের রাস্তা সিধা রানিক্ষেতের দিকে চলে গেছে, তাই মাঝে মাঝেই তীব্র বেগে গাড়ি চলে যাচ্ছে সাথে অকারণ হর্ন বাজিয়ে, জঙ্গলের নীরবতা ভঙ্গ করে ।

তবু নেমেছে ছায়া, দীর্ঘতর হয়েছে তার আকার। খাই এর ধারে একটা অস্থায়ী বেঞ্চে বসে আছি, সামনে বয়ে যাচ্ছে শীর্ণকায় কুশি নদী। নদীর ওপারে ঘন জঙ্গল আর পাহাড়। পলক না ফেলে সন্ধানী চোখ খুঁজে চলে বিশালকায় কোনো গর্বিত হস্তিনী বা ডোরা কাটা কালো হলুদে জার্সি পড়া সেই রয়্যাল কে। ঠান্ডা হাওয়া চোখে মুখে ঝাপটা মেরে যাচ্ছে, ঝিঁঝি পোকা সুযোগ পেয়ে আরো সরব হয়েছে। সব মিলে মিশে পরিবেশ অতি মনোহর। ক্লান্ত টিয়ার দল ডেকে ডেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, শুকনো পাতা খসে পড়ার আওয়াজও এখন শুনতে পাচ্ছি।

রাতে বেরিয়েছিলাম গাড়ি নিয়ে। বেশ কিছুটা যাবার পর হঠাৎ গাড়ি থামাতে হলো, সামনে এক ঝাঁক হরিণ। spotted ডিয়ার বা চিতল ছিল, গাড়ির হেড লাইটের আলোয় ওদের মসৃন ত্বক চকচক করছিল। আচ্ছা এরাও কি নিজেদের ত্বক ভালো রাখতে দই খায় বা কোনো রূপটান দেয় 😇 বড় জানতে ইচ্ছা হয়। কিছু হঠকারী চালকের জন্য এমন দৃশ্য দীর্ঘস্থায়ী হলো না। আবার এগিয়ে চলা। কিছুটা যাবার পর একটা শুকনো  জলধারা পেলাম । সেখানে আগে থেকেই একটা জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। আমরাও দাঁড়ালাম। প্রথমে বেশ কয়েকজোড়া জ্বলন্ত চোখ নজরে এলো। অন্ধকারে চোখ ধাতস্থ হতে আর অন্য গাড়ির আলো পড়তে দেখলাম খান পাঁচেক সম্বর দাঁড়িয়ে সাথে একটি বাচ্ছাও। তারাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ করলো । আবার কিছুটা এগোতেই আবার একটা জলধারা , সেখানে দেখলাম এক বিশাল টাস্কর বা দাঁতাল কে। প্রথমে বোঝা যায়নি তার উপস্থিতি, নিজেকে ঝাড়ির আড়ালে রেখেছিল। ভালো করে বুঝতে বুঝতে অনেকটা কাছে চলে আসে । একটু ভয় তো পেয়েছিলাম বটেই। দ্রুত সেখান থেকে কোন আওয়াজ না করে বেরিয়ে যাওয়া হলো। রাতের জঙ্গলের আলাদা গন্ধ ।

৬/৬/২০১৮
সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। ঘরের একদিকের দেওয়াল পুরো কাঁচের । পর্দা সরালেই জঙ্গল হাতছানি দেয়। রেস্ট হাউসের কুকুরটা মাঝে মাঝেই ডেকে উঠেছে। আর ততবার আমি পর্দা সরিয়ে দেখেছি ,,,যদি বিশেষ কারো দর্শন পাওয়া যায়। এভাবেই কখন পৌনে চারটে বেজে গেল । আবার সাজ সাজ রব। ঠিক চারটে বেরিয়ে পড়লাম আমরা চারজন আর ড্রাইভার ভাই পাপ্পু যোগী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পাপ্পু ভাই খুবই ভালো চালক ও সাথী। দূরের ও দুর্গম জায়গায় ভালো চালক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বটে।

চারিদিকে এখন আর বেশি অন্ধকার যেন। প্রতিটা মুহুর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি তার দেখা মেলে। পাহাড়ে আলো ফোটে খুব তাড়াতাড়ি। আবছা আলোয় জঙ্গল পাহাড় এর সে কি মায়াবী রূপ। মনে হচ্ছিল গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গিয়ে প্রকৃতিকে আলিঙ্গন করি। পরমুহূর্তেই মনে পড়লো নিজের সাথে সাথে আমার সাথীদের ও বিপদগ্রস্ত করবো আমি, তাই কিছু ভাবনা মনের মনি কোঠাতেই থাক। একে একে দেখা হল বার্কিং ডিয়ার, স্পটেড ডিয়ার, সম্বর । অপেক্ষা ছিল হাতির। বেশি দেরি না করেই দেখা দিলেন তারা। পুরো পরিবার সমেত। ছোট দুটো সদস্য সবচেয়ে মন কাড়া । একটি ছিল কৈশোর কালের, দাঁত একটু বড় হয়েছে। তার সামনে আমাদের গাড়ি দাঁড়াতে তার বাবা কাকা কেউ একজন অসন্তোষ প্রকাশ করে, তাই দেখে সাহস পেয়ে খোকাবাবুও দুই কান ঝাপটিয়ে মাথা নাড়িয়ে চলে যেতে বললো। আমরা এগিয়ে গেলাম । দূরত্ব বজায় রেখে গাড়ি থেকে নেমে প্রাণ ভরে দেখলাম তাদের গজগামিনী চলন, রাজসিক আচরণ। আবার কিছুটা এগিয়ে যেতে পরিখার মধ্যে দুটি হাতি, দুটোই দাঁতাল গাছের ডাল ভেঙ্গে প্রাতরাশ করতে ব্যস্ত। আরো কিছু দূর যেতেই সেই চওড়া শুকনো জলধারা । এক বিশালকায় দাঁতাল একাই ঘুরছে। অনেক্ষন ধরে তাকে দেখলাম। হঠাৎ সে জঙ্গলে অন্তর্ধান হতে আমরাও এগোলাম। কে জানতো সে আগেই আমাদের রাস্তায় আসবে বলেই, গাড়ি কিছুটা এগোতেই দেখলাম পাশের জঙ্গল থেকে সেই দাঁতাল বেরিয়ে আসছে। আমাদের গাড়ি আগে পিছনে সে। আহা সে কি অভিজ্ঞতা 'জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না।' বেশ কিছুক্ষণ আমাদের পিছু চলার পর সে রাস্তা বদল করলো।
ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে, মাখন দিয়ে আলুর পরোটা আর অমলেট খেয়ে একটু আরাম করে নিলাম। সারা রাতের ক্লান্তি দু চোখে নেমে এলো ।

সন্ধ্যা নামার একটু আগে আবার আমরা বেরিয়ে পড়লাম । ধান গির গেট এর কাছে পৌঁছাতেই দেখি সবাই গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে, রেঞ্জাররা ছোটাছুটি করছে, খোঁজ নিয়ে জানলাম এক পাল হাতি বেরিয়ে এসেছে রাস্তার উপর। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম। কি মন ভরানো দৃশ্য তিনটে শিশু হাতি নিয়ে অনন্ত পক্ষে ১২-১৪ জনের হাতিদল। রাস্তা ছেড়ে তারা পাশের জঙ্গলে নেমে ভোজনে মনোনিবেশ করতে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হলো। আমরা বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে সে মনোরম দৃশ্য উপভোগ করলাম। এগিয়ে গেলাম আরো কিছুটা, অনেক চিত্রল ও সম্বর দেখলাম । ফিরে আসার সময় আবার হৈ হৈ কান্ড । কিছু ড্রাইভার খবর দিলো একটা দাঁতাল একটা গাড়িকে আস্তে করে ঠুকে দিয়েছে । তবুও এগিয়ে চললাম,  গেস্ট হাউসে ফিরতে হবে । বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সেই শুকনো জলধারার কাছে আবার সেই দাঁতাল, এবার দুটো। আলো আধারিতে ফটো তোলা যাচ্ছে না। ফ্ল্যাশ ব্যবহার করলে বন্য প্রাণীরা বিরক্ত হয়। যথাসম্ভব সাবধানে এগিয়ে গেলাম ওদের পাশ দিয়ে। একটা ঠান্ডা স্রোত যেন শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল। একেই বলে জঙ্গল মে দঙ্গল । যার ঘর সেখানে গিয়ে আমরা হুজজুতি করছি, তারা কেন তাহলে রাগবে না? বাইক চালকরা বিনা সাইলেন্সারে ভয়ংকর আওয়াজ করে চলে যাচ্ছে, অরণ্যের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে। কি আনন্দ তারা পায় জানি না।

৭/৬/২০১৮
আজ আমাদের ফিরে যাওয়া। মন ভারাক্রান্ত । আমাদের মন খারাপ যেন জঙ্গলেও ছড়িয়ে পড়েছে, তাই বুঝি শুনি না পাখির ডাক, পাই না হরিণের দেখা, বাঁদরের উঁকি ঝুঁকি। জঙ্গল এ ঘুরতে গেলেই হবে না, জঙ্গল কে ভালোবাসতে হবে। নিজেদের শহুরে আবর্জনা ছড়িয়ে আসলে হবে না । আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করে তথাকথিত সভ্যমানুষ কাকে জানান দিতে চায় নিজের উপস্থিতি, জানিনা। অরণ্যের গন্ধ, নীরবতা কিছু না কিছু জানিয়ে যায়। জিম করবেট নই আমি, শুধু পড়েছি, উপলব্ধি করেছি । চেষ্টা করেছি প্রকৃতিকে নিখাদ ভালোবাসা টুকু ফিরিয়ে দিতে। আবার ফিরে আসবো, নিশ্চিত... কোন পাখি বা গাছ হয়ে ।

No comments:

Post a Comment