
ছোটবেলার সবচেয়ে মজার দিন ছিল বাংলা নববর্ষের দিনটা। সেদিন নিজেকে বেজায় বড়লোক মনে হতো। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতেই মা এর সাবধান বাণী," আজ যেন দুস্টুমি করবিনা। আজকের দিনে বকা ঝকা করতে নেই। আমায় যেন ....." ব্যাস বাকি কথা পরে হবে। বাড়িটা এমনিতেই খাবারের গন্ধে মম করছে। তাড়াতাড়ি করে স্নান করে নতুন জামা পরে ঠাকুর প্রনাম করে বাড়ির সব গুরুজনকেও প্রনাম করা আমাদের অলিখিত নিয়ম।আজ ঠাকুর ঘরে ও যেন এক মায়াময় গন্ধ ছড়িয়ে আছে। আজ প্রসাদে শুধু বাতাসা নয়, সাথে আছে সাদা গুজিয়া, পাঁচ রকমের ফল। আহা সে বড় ভালো লাগার জিনিস। ততক্ষন সাদা সাদা ফুলকো লুচি, আলুর তরকারি কালো জিরে ফোড়ন দিয়ে , সাথে মিষ্টি- রসগোল্লা, জিলিপি সবাই অপেক্ষা করে আছে। কি আনন্দ। বাববা বাঁচা গেল, ওই বিচ্ছিরি দুধ টাও আজ বাদ। খেয়ে নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি, মা এর ডাক শুনতে পেলাম, " আজ কি একটুও পড়া হবে না, বিকেলে নাহলে মামাবাড়ি র মেলায় নিয়ে যাব না" । মেলা, সেকি মিস করা যায়। অগত্যা ব্যাজার মুখে পড়তে বসা। সময় যেন থমকে দাঁড়ায়। শামুকের গতিতে সময় এগিয়ে চলে। আবার দুপুরে একপ্রস্থ ভালোমন্দ খাওয়া চলে। কিন্তু আমার মন তখন চলে গেছে মেলায়। দুপুরের একটু পরেই মায়ের হাত ধরে চললাম মামাবাড়ি।

মামাবাড়ি ভারী মজা- সেখানে আমি একমাত্র নাতনি , একমাত্র ভাগ্নী, সবার ভীষণ আদরের। মামাবাড়ির ঠিক পাশেই এক পুরানো কালী মন্দির। সেই মন্দিরের বিশাল প্রাঙ্গণে মেলা বসে। ছোট নাগরদোলা, মেরি গো রাউন্ড , বন্দুক চালানো এইগুলো তো ছিলই। কিন্ত সবচেয়ে আমার ভালো লাগতো মাটির পুতুল, মাটির ঠাকুর , মাটির তৈরি রঙ বেরঙের ফল-সবজি আরো কত কি। মামাবাড়ি তেও সবাইকে প্রনাম করার পালা । চার মামা, দুই মামী, দাদু দিদা। মাসীরাও আসতো অনেক সময়, তখন যেন আরো চাঁদের হাট। সকাল থেকে অনেক প্রাপ্তিও হল আমার , যত জন কে প্রনাম করলাম সবাই টাকা দিয়েছে মেলা দেখার । কেউ ১ তো কেউ ৫ আবার কেউ ১০ ও। ওই সময় এই টাকাগুলোর মূল্য অনেক। আজ আমি তাই অনেক বড়লোক। ছোট ভাই বোনদের নিয়ে মেলায় যেতাম । নিজে হাতে জিনিস কিনতাম। আজ আমার অতি রক্ষণশীল মাও আমায় ছেড়ে দিত। কি আনন্দ, কখনো ১ টাকার ফুচকা তো কখনো ৫০ পয়সার আলু কাবলি। স্বাদ যেন আজ ও মুখে লেগে আছে। কি বড় বড় পাঁপড় ভাজা, আমসি, মিষ্টি গজা , হজমি গুলি- সব যেন হারিয়ে গেছে । আমি প্রতিবার মেলা থেকে একটা ঘাড় নাড়া বুড়ো কিনতাম, আর কিনতাম ঠাম্মার জন্য একটা ঠাকুরের মূর্তি। এই দুটি জিনিসের ব্যতিক্রম হতনা। আর কিনতাম ঝুলনের জন্য আরো কিছু খেলনা, যেমন গরুর গাড়ি, ছোট ছোট পাখি - এমনি আরো কত কি।

বাড়ির পাশে বলে কতবার যে মেলায় দৌড়ে চলে যেতাম তার ইয়াত্তা নেই। সময় যেন এইসময় ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে থাকতো। ভারাক্রান্ত মনে আবার বাড়ি ফিরে আসা। আজ হাতে অনেক টাকা আসলেও নিজেকে এতটুকু ধনী মনে হয় না। নেই সেই ছোটবেলার সরলতা, সেই নিষ্পাপ ভালোবাসা। মেলায় আসা লোকজনের সঙ্গে মিশে যাবার অনাবিল আনন্দ। সেই ১,২ টাকায় কেনা জিনিসের যে সুখ আজ তা ব্র্যান্ডেড জিনিসে নেই। আজকের নববর্ষ পালন অনেক এটিকেট মেনে হয়। এখন ছোটরা সবাইকে প্রনাম করতেও চায়না । আসলে আসে পাশের মানুষের প্রতি তারা হারাচ্ছে বিশ্বাস, তাই শ্রদ্ধা ব্যাপারটাও কোথাও হারিয়েছে। এই প্রজন্মের সেটা দোষ না। আমরাই আমাদের ভবিষ্যৎ কে একটা সুন্দর বর্তমান দিতে অক্ষম। আমি নিজেও খুঁজে পাইনা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, আন্তরিক ব্যবহার। ফেলে আসা দিন গুলো বড়ই বেদনা দেয় মাঝে মাঝে। আগামী বছর গুলোতে সে বেদনা বাড়বে বই কমবে না।
No comments:
Post a Comment