Wednesday, February 21, 2018

আমার মাতৃভাষা




"মোদের গরব মোদের আশা" সে আমার মাতৃভাষা-- বাংলা ভাষা। সবাই বলে কি মিষ্টি নাকি আমার ভাষা, যেন রসগোল্লা। কতই না মাতামাতি , কত প্রভাত ফেরী, কত গান কত আবেগ। দাঁড়ান , দাঁড়ান , বেশি ভেবে ফেলেছেন। এই উল্লাস , এই গর্ব ওই এক দিনের । আজকের ২১ফেব্রুয়ারি, দিনটা ভাষা শহীদ দের রক্তে রঞ্জিত এক প্রজন্মের লড়াইয়ের স্মরণ দিন । কিন্তু তার গুরুত্ব আজকের প্রজন্ম কোথায় দেয়? আজকের দিনে কটা সেলফি তুলতে পারবেন, কাকে ট্যাগ করতে পারবেন, বন্ধুদের থেকে লাইক কমেন্ট কত বেশি পাবেন সেটাই বিশাল চিন্তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। তাদের বাংলা বলতে লজ্জা লাগে। "ওমা ইস, কি ব্যাকডেটেড। এখনও  বাংলায় কথা বলিস" --- এমন ধিক্কার যেন শুনতে না হয় বন্ধুদের কাছে। তাই প্রানপন প্রচেষ্টা আধুনিক হওয়ার। তারা জানে না , যে নিজের মাতৃভাষা র সম্মান করতে পারে না, তাকেও কেউ সম্মান করে না। কবি মাইকেল বুঝেছিলেন সময় থাকতে , তাই আমরা পেয়েছি মন্দাক্রানতা ছন্দ, পেয়েছি মেঘনাদ বধ কাব্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবার প্রিয় ,কিন্তু আজকের প্রজন্ম কতটুকু হেঁটেছে  গোরার পদক্ষেপে কিংবা গা ভাসিয়েছে অমিত লাবণ্য এর প্রেমের ভেলায় । কোথায় সেই ভাষার কারুকাজ , কোথায় সেই প্রেমসিক্ত ভাষা যা হৃদয়ের গভীরতম তলদেশ থেকে উঠে আসে আর মনকে করে উদাসী বাউল।
বাংলা বানান আজ নিজের স্বরূপ হারিয়েছে। অবক্ষয় এর শুরু অনেকদিন । আজ তার অস্থিমজ্জা সার অবস্থা। হে নবীন, রঙিন দুনিয়ার মায়া জাল থেকে বেরিয়ে একটু দেখুন না । নিজের ভাষার বাগান টাকে আবার সাজিয়ে তুলুন। আজ যদি ভাষা আন্দোলন এর দামামা বাজে কেউ কি এগিয়ে আসবেন ফেসবুক আর ট্যুইটার ছেড়ে , বুক পেতে নেবেন ওই নাম না লেখা বুলেট ? নাকি শুধু অনলাইন পিটিশন ফাইলে আবদ্ধ থাকবে ভাষার বেঁচে থাকার লড়াই ?
যারা নির্দ্বিধায় বুক পেতে দিয়েছিল উপেক্ষা করে তাদের মায়ের ডাক , বাঁচাতে চেয়েছিল তাদের মাতৃভাষা তারা কি নিতান্তই বোকা ছিলেন ? জানি না। আমি নিজে বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী , আমার কাছে এই ভাষা শুধু ভাবপ্রকাশের মাধ্যম নয়। সে আমার অস্তিত্বের প্রমান, আমার বেঁচে থাকার রসদ। প্রবাসে আছি বহুদিন। সন্তানদের বাংলাভাষী করেছি, কিন্তু পারদর্শী করে তুলতে পারিনি। তথাকথিত স্কুলের পড়ার চাপ তাদের সেই অবসর দেয় না, আর আমার অক্ষমতা আমায় জর্জরিত করে। কিন্তু যারা বাংলায় আছেন তাদের কেন এই অপারগতা? আসুন না, আমরা সবাই মিলে এক শপথ নিই, বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর। দরকার ছাড়া ইংরেজি, হিন্দি বলবো না। নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে বাংলা হোক একমাত্র সাধন। কেউ বাংলা বললে তাকে ছোট করব না, বের করে দেব না কোন পাঁচতারা হোটেল থেকে। যেখানে দেখব অপমান সেখানে বলবো" হোক কলরব" ।  নাহলে যে ব্যর্থ হবে ওই ছেলেমেয়েগুলোর জীবনদান। আজ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচিত "মাগো, ওরা বলে" কবিতাটি না স্মরণ করে পারলাম না । পড়ে দেখুন , যদি মনের কোণে এতটুকু স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে, তাহলে তাকে নিভে যেতে দেবেন না । তাকে বানিয়ে তুলুন মশাল , শুদ্ধ হোক আত্মা , শুদ্ধ হোক ভাষা।
"মাগো , ওরা বলে"

"কুমড়ো ফুলে ফুলে
নুয়ে পড়েছে লতাটা,
সজনে ডাঁটায়
ভরে গেছে গাছটা,
আর, আমি ডালের বড়ি
শুকিয়ে রেখেছি—
খোকা তুই কবে আসবি!
কবে ছুটি?’

চিঠিটা তার পকেটে ছিল,
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।

‘মাগো, ওরা বলে,
সবার কথা কেড়ে নেবে
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা, তাই কি হয়?
তাইতো আমার দেরী হচ্ছে।
তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে
তবেই না বাড়ী ফিরবো।
লক্ষ্মী মা রাগ ক’রো না,
মাত্রতো আর কটা দিন।’

‘পাগল ছেলে’ ,
মা পড়ে আর হাসে,
‘তোর ওপরে রাগ করতে পারি!’

নারকেলের চিঁড়ে কোটে,
উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে
এটা সেটা আরো কত কি!
তার খোকা যে বাড়ী ফিরবে!
ক্লান্ত খোকা!

কুমড়ো ফুল
শুকিয়ে গেছে,
ঝ’রে প’ড়েছে ডাঁটা;
পুঁইলতাটা নেতানো,—
‘খোকা এলি?’

ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠোনে, উঠোনে
যেখানে খোকার শব
শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।

এখন,
মা’র চোখে চৈত্রের রোদ
পুড়িয়ে দেয় শকুনিদের।
তারপর,
দাওয়ায় ব’সে
মা আবার ধান ভানে,
বিন্নি ধানের খই ভাজে,
খোকা তার
কখন আসে! কখন আসে!

এখন,
মা’র চোখে শিশির ভোর,
স্নেহের রোদে
ভিটে ভরেছে।"


অনিন্দিতা

No comments:

Post a Comment