ছোটোবেলা থেকে এক দাড়িওয়ালা বুড়ো দাদু’কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে চিনতে শিখেছি। ভালো গান,কবিতা, গল্প যাই শুনি সবই নাকি ওঁনার রচনা।মনে মনে ভাবতাম একটা মানুষ কি করে পারে এতো লিখতে। যত বড় হতে লাগলাম সুকান্ত, জীবনানন্দ, সুনীল বাবু, জসীমউদ্দিন একে একে এসে বই এর পাতায়, মনের প্লাটফর্মে ভিড় করলেন। কিন্তু না মনের ট্রেনগাড়ির একটি কামরা শুধু একজনের জন্যই বরাদ্দ রইল। বাকি তিনটি কামরায় বাকি সবার ভিড়। ওই কামরাটা শুধু তোমার জন্য রবিঠাকুর। তোমায় চাক্ষুষ না দেখলেও মনের ক্যানভাসে নিত্ত তোমার সাথে আমার কথা হয়। তুমি কি ওই দূরে বসে তা বুঝতে পারো রবিঠাকুর?! অবশ্য দূরত্বটা বড্ড বেশী। ওই পারলৌকিক ব্যাপার আর কি। কে যেন একজন আমায় বলেছিলেন-তোমার রচনা বাল্যে সখের খেলা, যৌবনে প্রেম-ভালবাসা আর জটিলতার ক্রীড়া আর বার্ধক্যে বাণপ্রস্থের আস্বাদন। সত্যিই তাই গো ঠাকুর। তোমার রচনা যতবার পড়ি তত তার স্বাদ বাড়ে, আরো নতুনতর আঙ্গিকের সন্ধান পাই। ওই যেন বৈষ্ণব পদাবলীর নবরস- যে যা চায় তাই খুঁজে পায়। যখন অমলের দইওলা পড়েছি তখন যেন নিজেকে অমল ভেবেছি। অলস দুপুরে জানালার দিকে চেয়ে ভেবেছি ওই বোধহয় দইওয়ালা আসলো। গল্পের গূঢ়তা তখন বুঝিনি। আর ওই যে কাবুলিওয়ালা- সেই জোব্বা পরা মানুষটাকে কলকাতার রাস্তায় আমার সন্ধানী চোখ অনেক খুঁজেছে। প্রথম পাঠে গোরাকে মনে হয়েছে এক কাঠ খোট্টা নিতান্তই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত একটি চরিত্র। কিন্তু তার অন্তরালে থাকা গোরার বেদনা-প্রেম অনেক পরে খুঁজে পেয়েছি। ঘরে বাইরের সন্দীপকে নিজের প্রাক্তন প্রেমিক বলে মনে হয়েছে। কিন্তু অমিত আর লাবণ্যের প্রেম কাহিনী ভাবতে শিখিয়েছে বিবাহে প্রেমের পরিণতি নয়। প্রেম হবে টলটলে জল মগ্ন এক হ্রদ, তাতে মনের কলসী রোজ ডুবিয়ে দেব আর নিত্য রঙ্গিন প্রেমে ভরে নেব তাকে।
“আজি এ প্রভাতে রবি’র কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আধাঁরে
প্রভাত পাখির গান……”
আমার স্বামীর মুখে রবিঠাকুরের পঙ্ ক্তি নতুন করে মনে নাড়া দিল। শুরু হয়েছিল আমাদের পথ চলা- রবিঠাকুর তোমাকেই সাক্ষী করে।
“চুমিয়া যেয় তুমি আমার বনভূমি
ওগো দখিন-সাগরের সমীরণ
যে শুভক্ষণে মম আসিবে প্রিয়তম
ডাকিবে নাম ধরে অকারণ।“
বিবাহোত্তর জীবনেও প্রেম তোমার হাত ধরেই এসেছিল রবিঠাকুর। কিন্তু প্রেম ভালবাসা তো সব না, “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু”- তোমার দুঃখ-যন্ত্রনাকেও যেন কোথায় নিজের বড় আপনার লাগে। জোঁড়াসাঁকোয় তোমার ঘরে বসে তাই আকুল ভাবে কেঁদেছি। তোমার বিশালতাকে আমি স্পর্শ করতে পারবোনা, সেই ধৃষ্টতাও রাখিনা। তোমায় আমি অনুভব করেছি আমার প্রতিটা অনু-পরমাণু দিয়ে। তুমি আছো, আমার মত করে তুমি আছো। কারোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তোমাকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। কারণ তুমি যে আমার রবীন্দ্রনাথ। তোমার লেখায় তোমার ভালোবাসা-আশীর্বাদ পেয়েছি। অনুভব করেছি হৃদয়ের গভীরতম তলদেশ থেকে, সেখানে একটি রাজসিংহাসন আর তাতে বিরাজমান তুমি , রবীন্দ্রনাথ।
অনামি