Friday, May 4, 2018

আমি অমিতা বলছি (২)


 মা চলে গেছেন আজ বেশ কয়েক মাস হল। কোথায় যেন এক অপূরণীয় শূন্যতা,,, দিনের কাজে যেন সেই ভাবে মন লাগে না । দুপুরের ভাত খেতে বসলে পাশের শূন্য আসন টা আরো কষ্ট দেয়। সকাল থেকে উঠে কাজ শুরু হয় । যে হাতে কিছু বছর আগেও খাতা কলম ধরা ছিল , আজ সেই হাত গোবর দিয়ে উঠোন নিকোয়। ঘুঁটে দেয়, গরুর জাবনা দেয় আর অনভ্যস্ত হাতে গরুর দুধ দোয়ায়। যখন বিয়ে হয়ে আসি একটা ট্রাঙ্ক এ আমার যাবতীয় বই খাতা আমার মেজ কাকা দিয়ে দিয়েছিলেন , যদি আমি প্রাইভেটে ম্যাট্রিক দিতে পারি। হয়নি সে সাধ পূরণ। বিশাল সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল । শুনতে হয়েছিল কটূক্তি আত্মীয় দের কাছে পড়াশুনো জানার জন্য। কিন্তু ওই যতদিন মা ছিলেন , উনি যেন সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়াতেন ।
ছেলে টা ছোট , আবার সন্তান সম্ভবা। এমন সময় হল জ্বর । উঠতে পারলাম না সারাদিন । দেখলাম আমার ছেলে টাকে ডেকে কেউ খাওয়ালো না। শুনলাম বড় জা শুধু নিজেদের জন্য ও বাবা শ্বশুরের জন্য রান্না করেছেন। ঘরে যা চিড়ে মুড়ি ছিল তাই খেয়ে পেট ভরালো পিতা পুত্র। এই ভাবেই চললো দিন তিনেক । প্রতিবেশী কাকিমার বদান্যতায় ছেলেটা দুমুঠো ভাত খেতে পেল। আমার শ্বশুর মশাই নীরবে পর্যবেক্ষণ করলেন সমস্ত ঘটনা। চার দিনের মাথায় নিজে দোকানে গিয়ে চাল ডাল আলু কিনে আনলেন। আমায় বললেন , "বউমা উঠোনে যে ধান সিদ্ধ করার উনুন আছে সেখানে রান্না করো । আর আজ থেকে আমি তোমাদের কাছেই খাবো "। জ্বরে আক্রান্ত দুর্বল শরীর আর সংসার ভাঙার কষ্ট নিয়ে প্রথম বার আলাদা রান্না করলাম। সেই রান্না ছিল বড়ই বিস্বাদ।  জীবনে ওরম রান্না কোনোদিন খেতে হয়নি আর ।
***************

শুরু হল জীবনের এক নতুন অধ্যায়। বড় ভাসুর রা জমির সবচেয়ে বড় অংশ নিয়ে আলাদা হয়ে গেলেন। আমার স্বামী বললেন সুখের চেয়ে স্বোয়াস্তি ভালো। কোন এক সকালে দেখলাম যে ঘরে তাঁরা থাকতেন সেটা পুরোটাই খুলে নিয়ে চলে গেছেন সাথে নিয়ে গেছেন শাশুড়ি মায়ের সমস্ত বাসন। নিয়তিও বোধহয় অলক্ষ্যে হেসেছিল ভাগ্যের পরিহাস দেখে । আমার উদার মনা স্বামীর মনে এইসব কান্ড কোনো রেখাপাত করেনা । বরঞ্চ নতুন উদ্যোমে কি করে আমাদের জীবন ধারা কে সুষ্ঠভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তাতে মনোযোগ দিলেন। নিজের জমির কিছু অংশ দান করলেন গ্রামে প্রথম লাইব্রেরি তৈরি করতে। মাঠকলের পাঠাগার টা আমার স্বামীর নিজের হাতে গড়ে তোলা। সেখানে অবসর সময়ে বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি ওষুধ ও দেওয়া শুরু করলেন। পাড়ার লোকেরা কেউ বাহবা দিল তো কেউ ,,,,,, থাক না কটু কথা ।

*****************

আগেই বলেছি আমার স্বামী প্রগতিশীল ছিলেন। গ্রামে আমাদের বাড়িতে প্রথম চা খাবার রেওয়াজ চালু হয়। সকাল বেলা এক বড় কটেলি তে চা হতো। গ্রামের অনেক বয়স্ক মানুষ আসতেন চা খেতে। চা এর সাথে দেওয়া হত ছোট ছোট ধামা করে মুড়ি। বাড়ির দাওয়ায় বসে চলতো তাঁদের আলাপ আলোচনা।
এখন কিছুটা সময় বাঁচে আমার।ছেলে আর স্বামী বেরিয়ে গেলে ঘরের কাজের শেষে দুপুরবেলা কিছুটা সময় থাকে  যা একান্তই আমার। আমার হাতের কাজের খুব শখ, তাই বানাই সোয়েটার, কুরুশের কাজের  লেস, বাচ্চাদের টুপি মোজা । আর বানাতাম ঘর সাজানোর জিনিস।
বিকেলে রাখাল গরু নিয়ে ফিরে আসতো। আমি সযত্নে লণ্ঠনগুলো পরিস্কার করে তেল ভরতাম। অন্ধকার হওয়ার আগেই ওগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। দিনের আলো থাকতে থাকতে যতটা সম্ভব কাজ গুছিয়ে নিতে হতো। রাতে লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসা নভেল পড়াটা আমার নেশা ছিল। মনে হতো এক অন্য জগৎ খুলে গেছে আমার সামনে।
*****************
বর্ষায় অনেক সময় ফুটো টালির ফাঁক দিয়ে জল পড়তো। বালতি হাঁড়ি বসিয়ে জল ধরতাম । এইসময় সাপের গর্ত গুলো জলে ডুবে যেত বলে ওদের যত্রতত্র দেখা যেত। সকালে উঠে উনুন ধরাতে গেছি দেখি রাতের পোড়া ছাইয়ের ওপর সাপ কুন্ডলি মেরে আছে , বা ধান সিদ্ধ র হাড়িতে , কিংবা মশারির চালে । পরিবারে এখন বাচ্চার সংখ্যাও বেড়েছে, বেড়েছে তাই আশঙ্কা। এমন ও দেখা গেছে সন্ধ্যায় বাচ্ছারা লন্ঠনের আলোয় দুলে দুলে পড়ছে আর তাদের পিছনে ছোট ছোট গোখরোও ফনা তুলে দুলছে। সে দিন গেছে চলে ,,,,,

**************

বর্ষার প্রকোপ কোমলে বাড়ির ছেলেরা যেত ধান ক্ষেতে , চাঁদনী রাতে । বড় বড় সড়কি, বল্লম আর জাল নিয়ে । সকালে যখন উঠলাম দেখলাম উঠোন ভেসে যাচ্ছে মাছে। যেসব মাছ জিওল তাদের আলাদা করে মেছলায় রেখে দেওয়া হতো জল দিয়ে । বড় মাছের ভাগ যেত আসে পাশের আত্মীয় স্বজনের বাড়ি। আর বেঁচে যাওয়া চিংড়ি ছোট মাছ গুলোকে ধুয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হতো বড় বড় কুলোর উপর । রোজ চলতো রোদ খাওয়ানোর পালা। কিছু তাজা কুচো/মেথি/ধেনো চিংড়ি আর ছোট মাছ পেঁয়াজ রসুন লঙ্কা কুচি  কালো জিরে দিয়ে কড়াই এ অল্প তেলে নেড়ে তারপর নারকেল দিয়ে সিলে বাটা হতো। সেই বাটায় কাঁচা সর্ষের তেল দিয়ে ভাত খাওয়া হতো। সত্যিই কি যে দিন গেছে চলে ফিরে আর আসিবে না ,,,,,,,,,

তখন তো ফ্রিজ ছিল না , তাই কিছু দেশি পদ্ধতিতে সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা হতো। যেমন বেশি মাছ হলে , বিশেষত ইলিশ হলে মাটির হাড়িতে একপ্রস্থ নুন বিছিয়ে মাছ রাখা হতো। আবার তার উপরে নুন দেওয়া হতো। মাটি খুঁড়ে হাড়িটা গলা অব্দি পুঁতে দেওয়া হতো । উপরে যথাযত ঢাকনা দিয়ে রেখে দিন দশেক চলে যেত । যতটা দরকার বের করে নিয়ে হালকা গরম জলে মাছ ধুয়ে রান্না করা হতো।

*************

জীবন সর্বদাই চলনশীল । কারো জন্য দাঁড়িয়ে থাকে না। মনে পড়ে এক পুজোয় আমার ছেলে তার  বোনের হাত ধরে গ্রামের ঠাকুর দেখতে যাচ্ছে।  মেয়ে আমার একটু সাজুগুজু করতে ভালোবাসে। তা সে নিজের জামা সামলাতে ব্যস্ত। কিন্তু ছলনাময়ী ভাগ্য দেখছিল আর হাসছিল মিটিমিটি। কিছুদিন আগেও বৃষ্টি হয়ে গেছে, মেঠো রাস্তা তাই আরো পিচ্ছিল । জামা সামলাতে গিয়ে দাদার হাত ছেড়ে একাই চলছিল সে,,,,, হঠাৎ পপাত ধরনী তল ।  এক হাঁটু কাঁদায় সে ডুবে গেছে। সবাই ছুটে এসে তাকে টেনে বার করলো। দেখা গেল নতুন জুতো জোড়া ছিঁড়ে কাদাতেই রয়ে গেছে। মেয়ের কান্নায় পুজো দেখা মাথায় উঠলো সবার ।
**********************
আলাদা হবার পর প্রায় এক যুগ কেটে গেছে । ছেলে মেয়েদের কিভাবে ভালো করে পড়ানো যায় সেই চিন্তাই আমার স্বামীকে ভাবিয়ে তুলেছে। শ্বশুর বাবা মারা গেলেন । ভিটের টান এর থেকে ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ এর চিন্তা বড় হয়ে উঠলো। স্টেশনের কাছে একটা ছোট জমি কিনে সেখানে বানানো হল অন্নদা ভবন ,  আমার শ্বশুর বাবা অন্নদা প্রসাদের নামে। সালটা ছিল ১৯৬১ । তিন ছেলে মেয়ে আর স্বামীর হাত ধরে শুরু হল আবার নতুন করে আমার পথ চলা।
**************